রোগ

মস্কার আমি ডাক্তার কৌশিকী কর্মকার,। একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। প্রায় দুই  মাসে আমার আরও একটা পরিচয় হয়েছে, মিঠির বেস্টফ্রেন্ড। মিঠি ওরফে ওলি সেন। ৬-৭ বছরের একটা ভীষণ মিষ্টি মেয়ে। বীনাদেবী শিক্ষা নিকেতনের ক্লাস-1 এর ছাত্রী। ভীষণ মিষ্টি হলেও এই অল্প বয়সেই একাকীত্ব তাকে গ্রাস করেছে। মেয়েটির বাবা-মা দুজনেই শহরের এক বড় সরকারি কার্যক্ষেত্রে কর্মরত। তাদের জীবনে সময়ের অতিরিক্ত অভাব। এমনকি একমাত্র মেয়েকে নিয়ে একদিন আমার চেম্বারে আসারও সময় নেই, জন্য মোটা টাকার বিনিময়ে আমাকে তাদের বাড়িতে ভিজিট করার আর্জি জানিয়েছেন।

দুই মাস আগে একদিন ওলির বাবা মিস্টার সেন আমার চেম্বারে আসেন, এবং বলেন ডাক্তার কর্মকার বড় বিপদে পড়েই আপনার কাছে আসা। মিঠি মানে আমার একমাত্র মেয়ে এই অল্প বয়সেই মনে হচ্ছে পাগল হয়ে গেছে। সারা দিনরাত চুপচাপ থাকে এবং আমরা (আমি এবং আমার মিসেস) বাড়ি আসার সাথে সাথে ভূত দেখার মত ভয় পেয়ে দৌড়ে পালায়!সময়ের বড় অভাব তাই আপনি যদি কাইন্ডলি একটু আমাদের বাড়িতে ভিজিট করতেন! চিন্তা করবেন না আপনাকে এর জন্য দ্বিগুণ টাকা দেবো। আমি বললাম এসব টাকার কথা রাখুন। আমি কাল থেকেই ভিজিট করবো।


পরদিন ছিল রবিবার। একটু সন্ধ্যা করেই গেলাম মিস্টার সেনের বাড়ি। কলিংবেল বাজাতেই মিসেস সেনন এসে দরজা খুলে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। নমস্কার, বসুন ।আপনার জন্য চা এর ব্যবস্থা করতে বলছি! একটু বসুন। এই মিতা! চা করতো ২ কাপ। এসব শুনে আমি মনে মনে ভাবছিলাম এইতো এত ভাল করে কথা বলছেন এত ভাল মানুষ! কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আমার ভুল ভাঙলো। ছোট একটা মেয়ে (মিঠিই হবে) ড্রইংরুমে এসে মিসেস সেনকে বলল ও মা আমার একা ঘুম আসছেনা, তুমি একটু আমার পাশে শোবে! মিসেস সেন যেন চিৎকার করে বলে উঠলেন দেখো মিঠি! তুমি খুব অভিনয় করতে শিখে গেছ। নাচের ক্লাস, ড্রয়িং এর ক্লাস,স্কুল সব জায়গা থেকে কমপ্লেন শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ আমি! পরক্ষণে আমার দিকে ঘুরে বলতে লাগলেন জানেন ডক্টর কর্মকার স্কুল থেকে সেদিন প্রিন্সিপাল জানালেন বেঙ্গলি এক্সামে  পরিবার নিয়ে রচনা এসেছিল। সেই জায়গায় খালি রোগ-রোগ লিখে রেখেছে।অথচ এক্সামের আগে টিউশন টিচার কত ভালো করে পড়ালেন।  ডান্স ক্লাসে ডান্স না করে করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, ড্রয়িং ক্লাসে টিচার পেরেন্টসদের নিয়ে ছবি আঁকতে বলেছিল। সেখানেও কিসব উল্টোপাল্টা একে রেখেছে! অথচ অন্যান্য ছবি কি সুন্দর আঁকে! ওর এসব নাটকের জন্য টাকা-পয়সা ফালতু জলে যাচ্ছে।আমি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললাম আচ্ছা আমার পেশেন্টকে তো নিয়ে আসুন এবার! মিঠি আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে আমার দিকে মিষ্টি একটা হাসি হেসে, এমনকি চোখে-মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই (যেমন টা মিস্টার সেন বলেছিলেন) একগাল হেসে বলল তুমি কেগো? আমার বন্ধু নাকি! আমিও হেসে বললাম হ্যাঁগো তোমার বন্ধু। মিসেস সেন কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিলেন। আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম আচ্ছা এখন থেকে কিন্তু ডাক্তার আর পেশেন্টের আলোচনার মাঝে কেউ আসবে না। এরপর আমি কিছু গল্প করলাম মিঠির সাথে। ইতিমধ্যে মিতা চা নিয়ে হাজির! চা খেয়ে উঠে দেখি রাত আটটা বাজে। মিসেস সেনকে বলে সেদিন বিদায় নিলাম। এরপর সপ্তাহে দুদিন স্থির হলো এই বাড়িতে আসার জন্য। রবিবার ও বুধবার।

বুধবার এসে দেখি মিস্টার ও মিসেস সেন তখনও আসেননি। বাড়িতে ঢুকে দেখি মিঠি ড্রইংরূমে চেয়ারে বসে। যেন আমারই অপেক্ষা করছিল। আমি গিয়ে একটা চেয়ারে বসতেই বলা শুরু করলো অনর্গল কথা। যেন কয়েকশো বছর ধরে মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। জানো বন্ধু বাড়িতে, স্কুলে কোথাও আমার কোনো বন্ধু নেই। কেউ কথা বলে না আমার সাথে। বাবা-মার তো সময়ই নেই। কোনদিনও ঘুরতে নিয়ে যায়না বাড়িতে এসে দুজনে শুধু ঝগড়া করে আর বকে আমাকে! সব শুনলাম! তারপর মিঠিকে বললাম একটা ছবি আঁকতে। কি সুন্দর একটা সিনারি আঁকলো। তারপর যেই বললাম বাবা মা ও তার নিজের ছবি আঁকতে একসাথে সেই একইরকম উল্টোপাল্টা আঁকতে শুরু করল। এরপর দিন যেতে থাকে। আস্তে আস্তে অনেকটা স্বাভাবিক হতে থাকে মিঠি কিন্তু তার বাবা-মার বিষয়ে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়না।

আজ মিস্টার সেনের সাথে ডিল অনুযায়ী মিঠির বাড়িতে আমার শেষদিন। তবে আমি মিঠিকে কথা দিয়েছি আমি মাসে একদিন করে মিঠির সাথে গল্প করতে আসবো এবং অনেক গল্প করব। মিস্টার সেন কিছুক্ষন হল অফিস থেকে এসেছেন। এসেই আমাকে প্রশ্ন করছেন রোগটা কি সারাতে পারলেন ডক্টর? আমি কাতর কন্ঠে বললাম না পারিনি, আর পারবোও না! মিস্টার সেন যেন চিৎকার করে উঠলেন। দ্বিগুণ টাকা দেবো বললাম তাও পারলেন না।আমিও বলে উঠলাম দেখুন সবকিছু টাকা দিয়ে কেনা যায় না। আর সবথেকে দুঃখের বিষয় হলো আপনারাই (বাবা-মা সব থেকে আপনজন) হলেন ওর রোগ!

বিশেষ দ্রষ্টব্য-এখানে কোন বাবা-মাকেই ছোট করতে চাওয়া হয়নি।কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বিষয়টা গল্প হলেও সত্যি!

                                                রোগ - Prajapatir Dana Publication.pdf

Comments
* The email will not be published on the website.
I BUILT MY SITE FOR FREE USING