যন্ত্রণা

যন্ত্রণা

সায়ন্তিকা দেবসিংহ


কিরে গুবলাই!কিরে !কখন থেকে ডেকেই চলেছি। কানে তুলো গুঁজে শুয়ে আছিস নাকি?(গুবলাই অম্লান বাবুর একমাত্র মেয়ে। বড় আদরের। গুবলাই দেখতেও যেমন গুনেও তেমন ,কথায় আছে না রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী।কিন্তু সে একটু বড় হওয়ার সাথে সাথেই তার যেন মতিভ্রম হলো। পড়াশুনা মন নেই।টিউশন থেকে, স্কুল থেকে প্রতিনিয়ত নানা বিষয়ে অভিযোগ।গুবলাই এর বয়স ১৮ চলছে। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী! সামনেই ক'মাস পরে বোর্ড এক্সাম। আর ঠিক এই সময়ে কিনা তার এই মতিভ্রম!এই বয়সে যা হয় আরকি! তাকে নিয়ে অম্লান বাবুর চিন্তার শেষ নেই। বড় আদরের দুলালী কিনা! তার ওপর বাবা মেয়ের মিষ্টি সম্পর্কে কোথাও যেন চিড় ধরেছে। অম্লানবাবু বুঝতে পারেন গুবলাই যেন সবসময় কেমন একটা দুশ্চিন্তা, চাপের মধ্যে থাকে। একটা চাপা, গভীর যন্ত্রণা তার মিষ্টি পরী কে যেন করে শেষ করে দিচ্ছে। তিনি কিছু বলতেও পারেন না, কারণ কোনদিনই মেয়ের জীবনে অযথা আগ্রহ দেখাননি। যখন মাঝে বলতে গেছেন অযথা তর্ক করে গেছে গুবলাই তার সঙ্গে তার বাবা নাকি তাকে বোঝেনা!)

অম্লান বাবু একটা চাপা যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। নিজের মেয়েকে তিনি চিনতে পারছেন না; একি হলো? একি পরিবর্তন! অমলবাবু মেয়ের কোন বিষয়ে বেশি মাথা ঘামান না; এমনকি মেয়েকে ঘুম থেকে ওঠেন না কোনদিনও আজও তার ইয়ত্তা নেই। মেয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে তিনি গুবলাই এর ঘর থেকে বের হয়ে যান।

গুবলাই এর বাবা অর্থাৎ মি:অম্লান দত্ত শহরের এক বেসরকারি কার্যালয় উচ্চপদস্থ কর্মচারী, আর ওনার স্ত্রী অর্থাৎ গুবলাই এর  মা ইপ্সিতাদেবী গৃহবধূ ,আর তাদের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার। কোন কিছুরই অভাব নেই। অঢেল টাকা-পয়সা। মেয়ে ছোট থাকতে তার জন্য আলাদা , তার পছন্দমতো সাজানো ঘর ,আলমারি, এমনকি বাথরুম তৈরি করে দিয়েছেন। প্রতি বছর বিদেশ ভ্রমণ। প্রতি উইক এন্ডে শপিং, খাওয়া-দাওয়া, এলাহি ব্যাপার স্যাপার। অম্লানবাবু কোনকিছুর অভাব রাখেন নি। কিন্তু গত এক বছর ধরে তিনি গুবলাই এর পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। এর জন্য জীবনে প্রথমবার অনেক বকাঝকাও করেছে আদরের মেয়েকে । বকাঝকা করে তার মনে যন্ত্রণার শেষ নেই ।মাথা ঠান্ডা করতে তাই তিনি অফিস যাওয়ার আগে 10 মিনিট খবরের কাগজে চোখ বোলান। আর আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি ।কিন্তু খবরের কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ কি মনে করে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখেন দশটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। মনে মনে ভাবছেন এত দেরি করে তো গুবলাই কখনো ঘুমায় না। তিনি ভাবলেন একবার ডেকে আসবেন কিনা! তারপর ভাবলেন এদিকে অফিসের দেরি হয়ে যাবে ।তাই তিনি তার স্ত্রীকে ডাক দিলেন! কিগো ইতু (ঈপ্সিতা দেবীকে ভালোবেসে তিনি ইতু বলে ডাকেন)  তোমার আদরের দুলালীকে এইবার ডাকো।(ঈপ্সিতাদেবী মেয়েকে ডাকতে চলে গেলেন, আর অম্লানবাবু চলে গেলেন নিজের ঘরে তৈরি হতে।)এক মন দিয়ে অম্লানবাবু তৈরি হচ্ছিলেন। হঠাৎ স্ত্রীয়ের আর্তচিৎকারে চমকে ওঠেন এবং দৌড়ে যান মেয়ের ঘরের উদ্দেশ্যে।গিয়ে তিনি যা দেখলেন তা তিনি কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি। গুবলাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন ঈপ্সিতাদেবী, আর বিছানার পাশে পড়ে রয়েছে ঘুমের ওষুধের ফাঁকা শিশি। বুঝতে আর বাকি নেই কি সর্বনাশটা ঘটে গেছে! যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে উঠলেন তিনি এক মুহূর্তে। গুবলাই এর মা সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারান।অম্লানবাবু সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করলেন। তাদের বাড়ির পাশেই নামিদামি চিকিৎসক ডাক্তার আদিত্য চৌধুরীর চেম্বার ।তাই আসতে বেশী দেরী হয়নি। তিনি এসে গুবলাইকে চেক করলেন।


(I am sorry Mr that she is no more).আপনার মেয়ে সকাল আটটা নাগাদ এক্সপায়ার করে গেছে। কিছু করার ছিল না। আপনার তো এত টাকা-পয়সা এত নাম,ডাক একটু দায়িত্বটাও বাড়াতে পারতেন। এত দায়িত্বজ্ঞানহীন আপনি? আমাকে ক্ষমা করবেন কিন্তু আপনি সত্যিই দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাক্তি! এইবলে ডঃ চৌধুরী বিদায় নিলেন।


কথাগুলো শুনে যেন অম্লানবাবু স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার মনে অনেক ক্ষোভ ,রাগ ,জমাট বাধতে লাগলো ।মেয়ে বলতো তিনি নাকি মেয়েকে বোঝেন না! ডাক্তার চৌধুরী বলে গেলেন তিনি নাকি দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তি। এত অপমান ,এত অপবাদ ,আমাকে না জেনেই, না বুঝেই। কান্নায় ভেঙে পড়তে ইচ্ছা করছিল কিন্তু না এখনো তো কাজ বাকি আছে।

স্ত্রীকে হসপিটালে এডমিট করতে হবে(ডঃ চৌধুরী তার স্ত্রীকে চেক করে গেছেন এবং বলেছেন তার স্যালাইনের দরকার), মেয়ের মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করাতে হবে ।তড়িঘড়ি তিনি পুলিশকে ফোন লাগালেন। পুলিশের গাড়ি এলো প্রায় আধা ঘন্টা পরে। ততক্ষনে বাড়ির সামনে পাড়া পড়শির অনেক ভিড় জমে গেছে। অম্লানবাবুর নিজেকে কেমনজানি অপরাধী, অপদস্ত, আর হীন মনে হচ্ছিল।(ভালো মানুষ হিসেবে অম্লান দত্ত-এর এলাকাতে বেশ ভালোই নামডাক ।সবাই সম্মান, শ্রদ্ধা করে)।বাড়ির বাইরে এসে তাকে পাড়াপড়শির প্রশ্নের মুখে পড়তে হলো, ততক্ষনে পুলিশ বাড়ির ভেতর ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু তথ্য হিসেবে গুবলাই এর ঘরের টেবিলে  একটি সুইসাইড নোট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। পুলিশ তথ্য  পাওয়ার জন্য সুইসাইড নোটটি খুলে দেখল: তাতে যা লেখা রয়েছে: (অর্ঘ্য আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি তো কিছু চাইনি তোমার কাছে, শুধু শান্তি চেয়েছি। বাড়িতে কোন কিছুর অভাব নেই, শুধু একটা বন্ধুর অভাব। তোমাকে ভেবেছিলাম সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তুমিও বুঝলেনা।বিদায় ,ভালো থেকো, তোমার ভালোবাসার মানুষের সাথে)।পুলিশ অফিসার অম্লানবাবুকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন অর্ঘ্য কে? তিনি এই ব্যাপারে কিছু জানতেন কিনা! কিন্তু অম্লানবাবুর কানে যেন কোন কথাই যাচ্ছেনা! পাথরের মত হয়ে গেছেন যেন! আর হবে নাই বা কেন তিনি তো মনে হয় অন্য জগতে চলে গেছেন হ্যাঁ সেই জগৎটা ২৫ বছর আগের সালটা ২০১৮ কি ১৯।অম্লান দত্ত, দেশবন্ধু বয়স হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ।পড়াশোনা তেমন ভালো না হলেও খেলাধুলায় তাকে টেক্কা দেওয়া মুশকিল ।আর দেখতেও তো সেইরকম! সব মেয়েরা পাগল তার পেছনে। আর অন্যদিকে অপর্ণ রায়, সেবা সদন এর দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দেখতে ততোটা অসাধারণ না হলেও ভারী মিষ্টি। পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ-গানেও পারদর্শী। সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী দুটো মানুষ। এদের দুইজনের হঠাৎ আলাপ হয় সোশ্যাল মিডিয়াতে। তারপরওকথা বার্তা, বন্ধুত্ব এবং অবশেষে অম্লানের অপর্নাকে প্রেম নিবেদন। অপর্ণা একটু অন্য প্রকৃতির মেয়ে ।সবাই অম্লানের রূপের জন্য পাগল হলেও অপর্ণার অম্লানকে একজন মানুষ হিসেবে ভালো লেগেছিল। তাই তার হ্যাঁ বলতে বেশি দেরি হয়নি। তবে অপর্নার সব ভালো হলেও একটাই দোষ ছিল মানুষ চিনতে ভুল করতো সে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।কয় মাস ঠিক থাকার পর অম্লানএর আসল রূপ বাইরে আসতে থাকে ।কারণে-অকারণে ঝগড়া, গালাগালি অপর্নাকে অতিষ্ঠ করে তোলে। কিন্তু অপর্ণা স্থির করে রেখেছিল সে অম্লানকে ঠিক পথে নিয়ে আসবেই! আর হ্যাঁ তাই কিছুদিন সব দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করত। তারপর অম্লানও যেন বদলাতে শুরু করলো ,ঠিক পথে আসতে শুরু করল। তখন অপর্ণাও আস্তে আস্তে শান্তি পেল। তারপর একসাথে একটু ঘুরতে যাওয়া, সময় কাটানো বেশ ভালই চলছিল। অপর্নার জন্মদিনের ছবি দেখে সব বন্ধুরা বলেছিলো( you both are made for each other.)


কিন্তু শুধু ছবিতে সুন্দর দেখাটাই প্রধান নয়।আসল জীবনে মিল থাকাটাই! কিন্তু সেটার যেন কোথাও অভাব ছিলো। অপর্নার যন্ত্রনায় থাকত সবসময়। তার বন্ধুরা বলতো তুই থাকিস না অপু যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাবি। কিন্তু কারো কথা শোনেনি সে। এমনকি বাড়িতেও তার ঝগড়া হতো, তার বাবার সাথে প্রতিনিয়ত ঝগড়ার কারণে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় ।শুধুমাত্র অম্লান এর সাথে থাকার জন্য সে সবার থেকে আলাদা, একাকী হয়ে যায়।  কিন্তু কি অদম্য মনের জোর তার! পড়াশোনা ঠিকমতো চালিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি অম্লানকেও ঠিকঠাক পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করত। কিন্তু সে তার নিজের আনন্দ মজাতেই ব্যস্ত থাকত অপর্নার কথায় কান দিতনা। তখন বোর্ড পরীক্ষার আর এক মাস বাকি। অপর্ণাকিছুদিনের বিরোতি চায় সম্পর্ক থেকে, কথা বলা থেকে।কারণ সেই সময় কথা বললে শুধু ঝগড়া হতো ।আর পরীক্ষার আগে অপর্ণা তা চায়নি। অম্লানও প্রথমবার অপর্ণার হ্যাঁ তে হ্যাঁ  মিলিয়েছিল।পরীক্ষা শেষ হল। প্রায় একমাস পর, অম্লানকে ফোন করবে অপর্ণা। সে তো খুব খুশি। কিন্তু ফোন করেই ফোন ব্যস্ত পায় সে। অভিমান করে বসে। প্রায় একঘন্টা পরে অম্লানের ফোন আসে । অপর্ণা ধরে নি কারণ সেই এক ঘন্টায় সে সব জেনে গেছে(অম্লান অপর একজনের সাথে কয়েক মাস ধরে সম্পর্কে আছে)। ফোনটা ১৬,১৭ বার বেজে কেটে গিয়েছে দেখে অপর্ণা অম্লানকে ফোন করে ।ওপাশ থেকে ভেসে আসে অকথ্য গালাগালি । অপর্ণাও বলে দেয় অম্লানকে: আমি কিছু চাইনি শুধু একটু শান্তি চেয়েছিলাম। বাড়িতে সব আছে শুধু শান্তি নেই। সেটাও দিলেনা। বিদায় ভালো থেকো।এরপরেও দমে যায়নি অম্লান। নিজের ঔদ্ধত্যকে চরিতার্থ করার জন্য নানা অপমান, অপবাদ ছড়িয়েছিল অপর্ণাকে নিয়ে। সব সহ্য সীমা ভেঙে ফেলে অপর্ণা শেষবারের মতো ফোন করে অম্লানকে বলে শুধু কয়েক বছর দেখো। সেদিন আমার সব থাকবে আর তুমি সব হারিয়ে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে শেষ হয়ে যাবে ঠিক আজকের আমার মত।কথাগুলো অপর্ণা বলেছিল অভিমানে ,আর অম্লান ভেবেছিল প্রতিশোধ। কারণ সেতো কোনদিনও বোঝেয়িইনি তার অপুকে। সে বলেছিল অপর্ণাকে তুই মরবি খুব বাজে ভাবে!


কি ব্যাপার স্যার! ব্যাপারটা কি! হঠাৎ পুলিশ অফিসারের ডাকে সম্বিত ফেরে অম্লানবাবুর। নিজেই নিজের মনে যেন বলতে থাকেন ইঁতুর জায়গায় অপু থাকলে গুবলাই হয়তো আজ বেঁচে থাকতো । আবার পুলিশ অফিসার বলে ওঠেন মি: দত্ত অনেক দেরি হয়ে গেছে পোস্টমর্টেম করাতে আরো দেরি হয়ে যাবে হসপিটালে গেলে। তার চেয়ে বরং নতুন একটা হসপিটাল খুলেছে শহরের নামকরা Aparna's SevaSadan(নামকরা ডাক্তার অপর্ণা রায় এর)। নাম শুনেছেন বোধকরি।ওখানেই কাজটা সেরে ফেলুন! অম্লানবাবু যেন আবার স্তব্ধ হয়ে গেলেন কয়েক মুহুর্ত! হঠাৎ তার ফোনের রিংটোনের আওয়াজে সম্বিত ফেরে তার ।ফোনটা তুলতেই অফিসের বস বলে ওঠেন অফিস স্পন্সর বদল করবে ।আজ অফিসে তাই সেই বিষয়ে একটা মিটিং ছিল। আজ তো আপনি অফিসে আসেন নি ,তাই আপনার চাকরিটা বাঁচাতে একটু অসুবিধা হবে।


অম্লান বাবু যেন শুনতে পেলেন তার মন দৈববাণীর মত বলছে: (দাঁত থাকিতে বুঝিতে হয় দাঁতের মর্ম

কর্ম করিলে ফল পাইতেই হবে এটাই মানবধর্ম)।


অম্লান বাবু অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে অস্ফুটে বলে ওঠেন আআআআআআ  'যন্ত্রণা'!

যন্ত্রণা - Prajapatir Dana Publication pdf.pdf

Comments
* The email will not be published on the website.
I BUILT MY SITE FOR FREE USING