তথাগত গাঙ্গুলি
অরুন বাবু লেখাটা থামিয়ে কাগজটা দলা মোচরা করে ডাস্টবিনে ছুড়ে মেরে বললেন ধুর এ আমার কম্ম নয় | ভুতের গল্প লেখাটা যে চাট্টি খানি কথা নয় সে বেশ ভালোই বুঝছেন তিনি | ব্যালকানির জানালাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালেন | ফুরফুরে একটা হাওয়া দিচ্ছে | বেশ শীত শীত ভাব | ঠান্ডাটা বেশ ভালোই পড়বে এবার | বাইরে টা ঘুটঘুটে অন্ধকার | আজ অমাবস্যা| তার উপর ভুত চতুর্দশী আর কাল কালী পুজো, তাই এত অন্ধকার | আজকের দিনে নাকি ভূতেদের বেশ ফুর্তি | তাঁদের আজকে অনুষ্ঠান | ভোজ হবে নানান | এসব গল্প মা ঠাকুমার মুখে মুখে এখন ঘোরে | অরুন বাবুর মা ঠাকুমাও এর ব্যাতিক্রম ছিল না | ছোট বেলায় এসব কথা শুনে বারোটা বেজে যেত অরুন বাবুর | আনমনেও একবার হেসে ফেললেন তিনি | পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল| কি বোকাই না ছিল তিনি এখন ভাবলেও হাসি পায় |কোথায় হারিয়ে গিয়েছে সেসব দিন |মা বাবা ঠাকুরমা কোথায় আর তারা | ষাট উর্ধ অরুন বাবুর এসব কথা ভাবলে বেশ মন খারাপ হয়ে যায় | মনটা উদাস হয়ে যায় তার | এমনিতেই তিনি বেশ কয়েক দিন ধরেই মনো কষ্টে আছেন | অরুন বাবু পেশায় একজন লেখক | মূলত প্রেমের গল্পই লেখেন তিনি | বই ও বেরিয়েছে গোটা পঞ্চাশ | বেশ জনপ্রিয় হয়েছে সেগুলো | বইমেলায় কয়েক ছেলে মেয়ে সাক্ষরও করিয়েছে | এ নিয়েই অরুন বাবু মনে মনে বেশ গর্বিত | এভাবেই কাটছিলো দিন | হটাৎ একদিন সন্ধে বেলা মন্দিরা পত্রিকার সম্পাদক টেলিফোন করে তাকে | আর ব্যাস্ হয়ে গেলো তারপর | সম্পাদক মশাই টেলিফোনের ও পাশ থেকে বলেন | হ্যালো অরুন বাবু বলছেন আমি মন্দিরা পত্রিকার সম্পাদক শ্রী বিনয় হালদার বলছি আপনার কাছে আবদার আছে, মানে আপনি যদি রাজি হন | অরুন বাবু একবার গলা খাকরি দিয়ে বললেন
কি আবদার
জানেনি তো সামনে কালী পুজো | আর আমার প্রত্যেক বার এই সময়ের সংখ্যা টা ভুত চতুর্থী স্পেশাল করি | মানে ভুতের গল্প ছাপা হয় আরকি | তা আপনি যদি এবারের সংখ্যার জন্য একটি ভুতের গল্প লিখে দিতেন তাহলে বেশ ভালো হতো আরকি | জানি আপনি ভুতের গল্প লেখেন না তবুও এটা আমার আপনার কাছে একটা অনুরোধ বলতে পারেন | এই রে ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলেন তিনি | ভুতের গল্প সেটা আবার কিভাবে লেখে | তিনি তো জানেনই না | তবুও সম্পাদক মশাই এর আবদার তার আর ফেলতে পারলেন না তিনি | সম্পাদক মশাই খুশি হয়ে ধণ্যবাদ জানিয়ে ফোন কেটে দিলেন | আর ফোন কাঁটার সময় বললেন লেখা তিনি কালী পুজোর দিন সকালে এসে নিয়ে যাবেন |
ফোন কাটার পড় অরুন বাবুর মনে হলো হাঁ তো বলে দিলাম কিন্তু কি লিখবেন তিনি | তিনি তো কোনো দিন লেখেন ওই নি | তাহলে | প্রথমটাই তিনি ভেবে ছিলেন যা হোক বানিয়ে কিছুই একটা লেখা যাবে এখন কিন্তু বারবার ওই লেখা যত আগাতে থাকে তার মনোবল ততো নষ্ট হতে থাকে | লেখার পড় লেখা কাটতে থাকেন তিনি | এখন লিখতে বসে বেশ ভালোই বুঝতে পারেন এ তার কম্মো নয় | হাতের সিগারেট টা শেষ হয়ে গিয়েছিল| অরুণবাবু নতুন আর একটা ধরালেন | তারপর ঘরের ভিতরে এসে ব্যালকনির জানলাটা বন্ধ করে দিলেন | ভাবলেন বাইরে থেকে একটু ঘুরে এসে যাক | রাতের খাওয়া আগেই সেরে ফেলেছেন তিনি | অরুণবাবু বাইরে বের হলেন |
তার বাড়িটা ময়দানের পাশেই | ভাবলেন সেখানে থেকেই একটু ঘুরে আসা যাক | অনেকদিন যাওয়া হয় না | মিনিটপাঁচেকের মধ্যেই অরুণবাবু ময়দানের এসে পড়লো | হাত ঘড়িটা ওপরে তুলে দেখলেন প্রায় নটা বাজে | কিছুক্ষণ বসে থেকেই চলে যাবেন তিনি | এই মনস্থির করে মাঠে প্রবেশ করেন তিনি | ময়দান টা তার বরাবরই বেশ পছন্দ | এখানে এলেই তার মনটা হালকা হলে যায় | সব দুঃখ কষ্টও মুছে যায় | এখন যেমন মনটা বেশ হালকা হয়ে গেছে | ভুতের গল্পের কথা টাও বেমালুম লোপ পাচ্ছে তার স্মৃতি থেকে | ঠান্ডা একটা হওয়ার ঝাপ্টা উত্তর দিক থেকে আসছে | সেই হাওয়ায় অরুণবাবুর কাঁচা পাকা চুল গুলো উড়ছে | বেশ ভালো লাগছে তার | এই মাঠে আসা তো আর আজ থেকে নয় | সেই যখন তিনি প্রেসিডেন্সি তে পড়তেন ঠিক তখন বন্ধুদের সাথে আসতেন আড্ডা দিতে |
আজকাল আর সে দিন কোথায় | ছোট ছোট্ট ছেলেদের তো আর আজকাল আড্ডা দিতে দেখাই যায় না | সে সব দিন এখন কম্পিউটার আর ভিডিও গেমস কেরে নিয়েছে | এখন শুধু তা ফটোফ্রেমে বন্দি হয়ে ধুলো জমাচ্ছে | কাল তাকে লেখাটা দিতে হবে বিনয় বাবুকে| কিন্তু কি দেবেন তিনি |কিছুই তো লেখেনিই তিনি | কথা দিয়ে কথার খেলাপ কখনো করেননা উনি | কাল বোধ হয় তাই হবে | দীর্ঘশাঁস ফেলে চোখটা বুঝলেন অরুণবাবু | মাথায় কোনো গল্পের প্লট আসছে না | আরে আপনি অরুন বিশ্বাস না | কথাটা শুনেই চমকে পিছনে তাকালো অরুণবাবু | দেখলেন এক ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হয়েছে সেখানে | লম্বায় সেটি পাঁচ ফুটের বেশি হবে না | সেটি আর একটু কাছে এগিয়ে আসতেই প্রায় বেশ পরিষ্কার হলো তার সারা দেহ | এবার ভালো তাকে ভালো মতো দেখতে পাচ্ছে অরুনবাবু | ভাঙা গাল চুপসানো ঠোঁট সারা মুখে অনেক দিনের না কাঁটা দাড়ি| শরীরের নিচের দিকে একটা ময়লা পাজামা আর তার সর্বাঙ্গে ঝুলছে একার ধূসর এন্ডির চাদর |বয়স আন্দাজ পঞ্চাশএর দোরগোড়ায় | দেখেই মনে হয় লোকটা খ্যাপাটে| ছায়া মূর্তিটি এবার হাত জড়ো করে অরুন বাবুর প্রতি হাত জড়ো করে নমস্কার জানিয়ে বললো নমস্কার আমি নির্মল কর্মকার | ভদ্রতার খাতিরে অরুণবাবুও পাল্টা নমস্কার জানালো | তারপর বললো তা আপনার পরিচয় | ভদ্রলোকটি এবার ঘাসের ওপর অরুণবাবুর মুখোমুখি বসলেন | মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে তিনি বললে আমার নাম তো আমিও আগেই বলেছি এবার আমার পরিচয় | আমি পেশায় একজন সরকারি চাকুরে আর আপনার লেখার অনেক বড়ো ভক্ত আর ম্যাজিক দেখানোর শখ আছে একটু | আপনার সব উপন্যাস ওই আমার পড়া | অনেক বার আপনার সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু সুযোগ পাইনি | রাতে এই সময়টা আমি ময়দানে হাঁটতে আসি | আজ আপনাকে এখানে দেখে আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না | আর ভাগ্যক্রমে আজ আপনার একটা বই ও আমার সাথে আছে | ভেবেছিলাম ময়দানে বসে নির্জনে আপনার বইটা পড়বো | আজই অফিস ফেরৎ এই বইটি আমিও নিয়ে এসেছি | যদি কিছু মনে না করেন তাহলে এটাতে আপনার একটা সাক্ষর পেতে পারি | এই বলে লোকটা বইটা এগিয়ে দিলেন তার দিকে | অরুন বাবু দেখলেন এটি তার সদ্য প্রকাশিত বই শেষ বেলা | এবার বইমেলায় এটিই একমাত্র এবারে বেস্টসেলার বুক হয়েছে | অরুন বাবু তার ফাউনটেন পেনটা বের করে ঝটপট একটা সাক্ষর করে বইটা ফেরত দিলেন | লোকটি মনমুগ্ধ হয়ে সেটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন | তারপর তার করেন নামিয়ে রেখে বললেন অনেক ধন্যবাদ|
------- আরে না না এ আরকি বড়ো ব্যাপার এটাই তো আমাদের লেখকদের কাজ পাঠকদের আবদার মেটানো | কিন্তু|
------ কিন্তু কি | লোকটি বললো
অরুন বাবু অসফুটে বললেন বোধ হয় এবার আর পাঠক দের আবদার মেটাতে পারবোনা | কেন? পাল্টা প্রশ্ন করলো লোকটি
------------আসলে মন্দিরা পত্রিকায় ! অরুণবাবুর কথা শেষ না হতে দিয়ে লোকটি বললেন আপনার ভুতের গল্প বের হবে তাই তো | অরুন বাবু তো অবাক লোকটি কিভাবে জানলো | মনের কথা পড়তে পারে নাকি ইনি | তবু অরুন বাবু নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন অনেক সময় লেখা ছাপবার আগের সংখ্যা তার পরের সংখ্যায় কি ছাপা হবে তা লেখককের নাম সমেত জানিয়ে দেওয়া হয় লোকটি হয়তো সেখানেই দেখেছে | লোকটি আবার বললেন
-------------- আমি কি করে জানলাম তাই ভাবছেন তাই না | জানি জানি আমি আরো জানি যে এই ভুতের গল্প নিয়েই আপনি দুশ্চিন্তায় আছেন | অরুন বাবু বিশ্বয়ে হতবাক হয়ে গেলেন | লোকটি এসব জানলো কি করে | এসব তো তার জানার কথা নয় | এ তো তার একেবারে মনের কথা আর লোকটি যদি কোনো জাদুর বলে মনের কথা জানতেও পারে তাও তো একথা তিনি এখন ভাবেন নি | তিনি শুনেছেন অনেক জাদুকর লোকের মুখ দেখে মনের কথা বলে দিতে পারে কিন্তু তা তো তখন সেই লোক যা ভাববেন সেই কথা | আর অরুন বাবু এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলেন তাও প্রায় মিনিট পনেরো আগে | এমন কি যখন তিনি তার সাথে কথা বলছিলেন তখনো একবারও নয় তাহলে |
------ হ্যা আপনি জানলেন কি করে |
-------- লোকটি আবার সেই স্মিত হাসি হেসে বললেন ওই যে আগেই বললাম আমি একটু আধটু ম্যাজিক জানি তাতেই আমি জানতে পারি
-----------ও
কিছুক্ষনের নীরবতা | অরুণবাবুর মনে হলো নির্মল কর্মকার নামটা কোথায় যেন শুনেছে | মনে করতে পারেননা তিনি | লোকটির কথা গুলোও কি রকম রহস্যময় | শুনলে গা শিউরে ওঠে |
নীরবতা ভেঙে লোকটি বলেন আপনি কি ভুতে ভয় পান | অরুণবাবু ঘাড় ঘোরালেন তার দিক|
আ ভুত ইয়ে মানে না কেন | না আপনাকে দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে | অরুন বাবু বললেন সে এক কালে ভয় করতুম কিন্তু আজকাল আর সেসব কিছু মনে করিনা | মুখে বললেও অরুণবাবু বেশ ভালোই জানেন ভুতে একটা ভয় আছে তার |জানেন তো আজকে ভুত চতুর্দশী | আজকের দিনে নাকি ভুতেরা বের হয় তাঁদের সভা বসে আজকে, | আজকের দিনে তাঁদের দলের নতুন মাথা নির্বাচিত হয় | বাবা ভূতেদের ও মাথা অরুন বাবু সহাসে বললেন | হুম হয় তো | তাঁদের মাথা বা রাজা আজকের দিনে তার চালা দের কে আদেশ দেয় যাও আজকের দিনে যাকে একা বাগে পাবে তাকে তুলে নিয়ে আসো | তারপর তার গাড় মটকে দিয়ে তাঁদের রাজ্যে নিয়ে চলে যাবে | বলেই খিল খিল করে একটা বিদঘুটে হাসি হাসলো সে | অরুন বাবু বললেন থামুন থামুন মশাই আর বলে কাজ নেই চুপ করুন | হাসি থামিয়ে লোকটি এবার বেশি গম্ভীর গলায় বললেন ভুতে এতো ভয় কিসে আপনার | তারা কি সত্যি খারাপ হয় | গলার আওয়াজএ গা শিউরে অরুণবাবুর | এ গলাটা কার এ যেন এক অজানা লোকের গলা | বেশ ভয়ে ভয় করছে তার | গলা শুকিয়ে এসেছে | লোকটি এবার উঠে দাঁড়িয়েছে | |তিনি নিজের সব শক্তি জড়ো করে বললেন খারাপ ভালো জানি না মশাই তবে তারা তো আর কেউ মানুষ নয় কে জানে ক্ষতি তো করতেও পারে |
কেন আমিও কি আপনার কোনো ক্ষতি করছি | মানে?
অরুন বাবু শুস্ক গলায় বললেন
মানে আরকি?
বলে হটাৎ পিছন দিকে হাঁটা আরম্ভ করলেন | মাঠের পাশে থাকা ল্যাম্পের আলোয় আসতে আসতে যেন প্রায় মিলিয়েই গেলেন | অরুণবাবু হতবাক | কি হলো তিনি কিছুই বুঝলেন না | লোকটি চলে যেতেই ভয় ভাবটা কেটে গেলো তার | হাত ঘড়ি টা দেখলেন প্রায় এগারোটা বাজে | এবার বাড়ি ফিরতে হবে তাকে | উঠে দাঁড়িয়ে তিনি মাঠের বাইরে যাবার সরু রাস্তায় পা বাড়াবেন এমন সময় মাঠের কুয়াশা ভেজা ঘাসে একটা কি জিনিস আবিষ্কার করলেন | কাছে যেতেই বুঝলেন সেটা সেই বইটাই যেটা একটু সেই ভদ্রলোকটির কাছে ছিল | বোধ হয় ফেলে গেছেন | একটা ঠান্ডা হওয়ার ঝোকা পুব দিক থেকে ভেসে এলো | হাওয়া টায় যেন একটা ফিসফিসানি আছে | খুব মন দিয়ে শুনলেন অরুণবাবু যেন কেউ বলছে লিখুন আমাদের কথা লিখুন | গলাটা কেমন চেনা চেনা ঠেকলো তার | হঠাৎ তার মাথায় একটা গল্পের প্লট যেন উঁকি দিলো | এতক্ষন যার লেস মাত্র ছিল না তার মনে | বাড়ি গিয়েই তিনি লেখার কাজ আরম্ভ করে দিলেন |
সকালে বিনয় বাবু লেখার পান্ডুলিপি যখন নিতে এলেন তখন সবে সকাল আট টা | দরজা খুলতেই বিনয় বাবু স্বভাব সিদ্ধ শুভ সকাল বলে নমস্কার জানালেন অরুণবাবু কে | অরুন বাবু প্রাতঃ রাস সেখানেই সেরে যেতে অনুরোধ করলেন | প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাগজওলা এসে কাগজ টা দিয়ে গেলো | অরুণবাবুর মুখে সারা রাত জাগায় ক্লান্তির দাগ |তিনি কাগজ টা নিয়ে মুখের উপর খুলে বসলেন |খাওয়ার টেবিলে লেখাটা পড়ে বিনয় বাবু বললেন খাসা হয়েছে মশাই দারুন| আপনি যে এরকম ভুতের গল্প লেখেন তা তো জানা ছিলো না |
আমিও কি আমি নিজে জানতুম অরুন বাবু হালকা গলায় বললেন | বিনয় বাবু আবার বললেন সেকি মশাই লেখাটার নাম টা তো দেয়নি টা কি নাম ছাপাবো |
রাতের সঙ্গী | অরুন বাবু অসফুটে বললো |
তার হাতে খোলা রয়েছে আজকের কাগজটাবিভ্রম - Prajapatir Dana Publication.pdf